*শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও কল্পতরু*
২৮শে জুলাই, ১৮৮৫ সাল। ঠাকুর সকালে বলরাম বাবুর বাটীতে এসেছিলেন। এবাড়িতে জগন্নাথের সেবা আছে। তাই দুপুরে শুদ্ধ অন্ন গ্রহণ করেছেন। খানিক বিশ্রামের পরে বিকেলে চলেছেন নন্দ বসুর বাটীতে। পায়ে কালো বার্ণিশ করা চটি জুতা, পরনে লাল ফিতাপাড় ধুতি, উত্তরীয় নাই। পালকি এগিয়ে চলেছে।
একটু পরে ওবাড়ী পৌঁছতেই ঠাকুরকে প্রণাম করলেন গৃহস্বামী। উপরের হলঘরে নিয়ে এসে বসানো হলো। নানা কথার পরে নন্দ বসু পরলোক এবং পাপের শাস্তি বিষয়ে জানতে চাইলে ঠাকুর বললেন, "তুমি আম খাও না! তোমার ও-সব হিসাবে দরকার কি? পরলোক আছে কি না----তাতে কি হয়----এসব খবর! আম খাও। 'আম' প্রয়োজন, তাঁতে ভক্তি----" নন্দ বসু জানতে চাইলেন আম গাছ কোথা? আম পাই কোথা? ঠাকুর বললেন, "গাছ? তিনি অনাদি অনন্ত ব্রহ্ম! তিনি আছেনই, তিনি নিত্য! তবে একটি কথা আছে----তিনি 'কল্পতরু----'
কালী কল্পতরু মূলে রে মন, চারি ফল কুড়ায়ে পাবি!
কল্পতরুর কাছে গিয়ে প্রার্থনা করতে হয়, তবে ফল পাওয়া যায়,----তবে ফল তরুর মূলে পড়ে,----তখন কুড়িয়ে লওয়া যায়। চারি ফল,----ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ। জ্ঞানীরা মুক্তি (মোক্ষ ফল) চায়, ভক্তেরা ভক্তি চায়,----অহেতুকী ভক্তি! তারা ধর্ম, অর্থ, কাম চায় না।"
মাত্র পাঁচ মাস তিন দিন পর এলো সেই দিন। ১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি, শুক্রবার। শ্রীরামকৃষ্ণদেব কাশীপুর উদ্যানবাটীতে। গলরোগের চিকিৎসার্থে তাঁকে কলিকাতায় আনা হয়েছে। প্রথমে শ্যামপুকুর বাটীতে আড়াই মাস চিকিৎসার পরেও স্বাস্থ্যের উন্নতি আশাপ্রদ নয়। তাই ডাক্তার সরকারের উপদেশ অনুযায়ী কাশীপুরে এই বাগান বাড়ীর ব্যবস্থা করেছেন ঠাকুরের গৃহী ভক্তরা। নরেন্দ্রনাথ সহ ছেলেদের মধ্যে কেউ কেউ ঘর ছেড়ে এখানে ঠাকুরের সেবায় নিরত। গৃহী ভক্তরাও নিত্য আসা যাওয়া করছেন। আজ বছরের প্রথম দিনে ঠাকুরের দর্শন লাভের আশায় এলেন বেশ কয়েকজন।
সকাল থেকে ঠাকুরের কাছে অনেকে এসে আশীর্বাদ পেয়ে গিয়েছেন। তাঁর কৃপা লাভ করেছেন হরিশ মুস্তাফিও। অপরাহ্নে গিরিশ, রাম, অতুল, অক্ষয়, হরমোহন, কিশোরী রায়, নবগোপাল ঘোষ, হারাণ, বৈকুণ্ঠ সহ আরও অনেকে উপস্থিত। অপেক্ষা করছেন বাগানের মধ্যি পথে আম গাছের তলায়----সেই আম গাছ। ঠাকুর কয় মাস আগেই যে আম গাছের প্রসঙ্গ করেছিলেন নন্দ বসুর সঙ্গে।
একটু পরে দোতলা থেকে অসুস্থ শরীরে নেমে এলেন ভগবান। সঙ্গে ভাইপো রামলাল। অনুসরণ করতে লাগলেন নীচের হলঘরে থাকা কয়েকজন ভক্ত। অশক্ত শরীরে ঠাকুর এগিয়ে চলেছেন বাগান পথে। গৃহী ভক্তদের কল্যাণে, তাদের প্রতি অহেতুক ভালবাসায় তিনি আজ সত্যিই কৃপা সিন্ধু। ঠাকুরকে দর্শন মাত্র এগিয়ে এসে প্রণাম জানালেন গিরিশবাবু। ঠাকুর বলছেন, "গিরিশ, তুমি যে সকলকে এত কথা (আমার অবতারত্ব সম্মন্ধ) বলে বেড়াও, তুমি (আমার সম্মন্ধে) কি দেখেছ ও বুঝেছ? গিরিশবাবু ঠাকুরের পদপ্রান্তে নতজানু। ঊর্দ্ধমুখে, করজোড়ে গদগদ স্বরে বলে উঠলেন, "ব্যাস-বাল্মীকি যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেন নি, আমি তাঁর সম্মন্ধে অধিক আর কি বলতে পারি।"
গিরিশের অন্তরের সরল বিশ্বাসে ও কথায় ঠাকুর মুগ্ধ হয়ে তাঁকে উপলক্ষ্য করে সমবেত ভক্তদের বললেন, "তোমাদের কি আর বলিব, আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হউক।" একটু পরেই ভক্তদের প্রতি প্রেম ও করুণায় আত্মহারা হয়ে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হলেন। প্রত্যেকে তখন আনন্দস্পন্দনে উদ্বেলিত। আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে স্পর্শ না করার প্রতিজ্ঞা ভুলে অবিরাম ঠাকুরের চরণ বন্দনা করছেন। ঠাকুর অবিরাম চৈতন্য বিলোচ্ছেন, সকলের বুকে স্পর্শ করছেন, আর ভক্তরা কেউ বাগান থেকে পুষ্প চয়ন করে ঠাকুরের শ্রীঅঙ্গে নিক্ষেপ করে পূজা করছেন, কেউ আনন্দাশ্রু বিসর্জন করছেন, কেউ নির্বাক, কেউবা ডাকছেন অপরকে। রামবাবু বলছেন----ঠাকুর কল্পতরু হয়েছেন, যার যা চাইবার, চেয়ে নাও গো। গিরিশবাবুর ভাব স্বতন্ত্র----যিনি না চাইতে সব দেন, তাঁর কাছে আর চাওয়ার কি আছে!
কথিত আছে মর্ত্যে একটি পারিজাত বৃক্ষ রয়েছে। এদিন যেন আম-পারিজাত-কল্পতরু সব মিলেমিশে একাকার। ভগবান নেমে এসেছেন ভক্তকে কৃপা করবেন বলে। আবার কৃপা করার জন্য বেছে নিয়েছেন আম গাছের তলা। কল্পতরুর সান্নিধ্যে সেই আম গাছ রূপ নিল কল্পতরুতে। কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে, কেউ যেন সিদ্ধির নেশায় বুঁদ হয়ে আছে, কেউ বা বাগানে গড়াগড়ি দিচ্ছে----এ এক অভাবনীয় ঘটনা যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না!
এই সময় নরেন্দ্রনাথ সহ অন্যান্য ছেলেরা ঠাকুরের ঘর পরিষ্কারের কাজে নিরত। দোতলার ছাদ থেকে দেখেও বাগানে আসার অবকাশ নেই। পরে ঘটনা শুনে কিন্তু 'কল্পতরু' বিষয়টি মানতে চাইলেন না। তাঁদের মতে 'কল্পতরু' হল একটি কাল্পনিক স্বর্গীয় বৃক্ষ। অমৃতমন্থনে যে পারিজাত বৃক্ষ উঠেছিল, তার কাছে যা চাওয়া হয়, তাই পাওয়া যায়। এই হলো 'কল্পতরু'। হরিবংশ পুরাণে এই গাছের উল্লেখ রয়েছে বটে। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মেও এই গাছের কথা স্বীকার করা হয়েছে। প্রসিদ্ধি আছে, ভাল বা মন্দ যে যা চায়, কল্পতরু তাকে তাই দেয়। কিন্তু ঠাকুর তো এরকম করেন নি, বরং নিজ দেব-মানবত্বের এবং জনসাধারণকে নির্বিচারে অভয়আশ্রয়প্রদানের পরিচয়ই এই ঘটনায় সুব্যক্ত করেছিলেন। অর্থাৎ 'কল্পতরু' নন, 'ঠাকুরের অভয় প্রকাশ' বা 'আত্মপ্রকাশপূর্বক সকলকে অভয়দান।'
জয় ঠাকুর জয় মা জয় স্বামীজী জয় ঠাকুর।
0 Comments